দ্য বেঙ্গল ফাইলস: কলকাতা স্ক্রিনিং, বিতর্ক ও ইতিহাসের সত্য উন্মোচন

Estimated reading time: 1 minutes

Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!

দ্য বেঙ্গল ফাইলস (২০২৫): কলকাতায় বিতর্কিত স্ক্রিনিং, দুই সংবিধান ও ঐতিহাসিক ভাবনা

কলকাতায় সম্প্রতি ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’-এর বিশেষ প্রদর্শনী নিয়ে উত্তাপ তৈরি হয়েছে। এই ছবিটির নির্মাতা বিবেক অগ্নিহোত্রী আবারও আলোচনায়, কারণ তিনি দাবি করেছেন ছবিটি দেখাবে কিভাবে বাংলায় এখনো দুইটি সংবিধান কার্যকর, যার ঐতিহাসিক শিকড় রয়েছে। সেটা শুধু সিনেমার গল্প না, বরং অনেক গভীর সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রশ্ন উত্থাপন করছে এই সময়ে।

বাংলার ইতিহাস, রাজনীতি, ও নাগরিক অধিকারের প্রসঙ্গ এতে উঠে এসেছে, যা তরুণ সমাজ ও চিন্তাশীল দর্শকদের কৌতূহল বাড়িয়েছে। পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী আগেও সাহসী বিষয়বস্তুর জন্য পরিচিত ছিলেন, এবারও তিনি নতুন বিতর্ক আর আলোচনার সূত্রপাত্র। আজকের দিনে এই ছবির গুরুত্ব বাড়ছে, কারণ সংবিধান, আইনি শাসন আর স্বাধীন চিন্তার প্রশ্ন বারবার সামনে আসছে।

আরো জানতে চাইলে দেখুন: THE BENGAL FILES Official Trailer | Vivek Agnihotri

সিনেমার বিষয়বস্তু ও ঐতিহাসিক পটভূমি

‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ ছবিটি সহজভাবে বললে ইতিহাসের এমন এক অধ্যায় নিয়ে তৈরি, যা নিয়ে আজও রক্ত গরম হয়। পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রীর আলোচিত ‘ট্রুথ ট্রিলজি’ সিরিজের এই তৃতীয় ছবি, যেখানে অতীতের বিতর্কিত ঘটনা, সামাজিক বিভাজন, আর রাজনীতির ছায়া-সমস্যা উঠে এসেছে গল্পের মূল স্রোতে।

ছবিটিতে ১৯৪৬ সালের একটি বিশেষ সময়—ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে, নোয়াখালি গণহত্যা, পার্টিশনের সময়কার মুসলিম-হিন্দু সম্পর্ক এবং গোপাল চন্দ্র মুখার্জির উপস্থিতি—এই সব গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। প্রতিটি ঘটনা বাস্তব, কিন্তু বহুদিন ধরে আনুষ্ঠানিক ইতিহাসে চাপা পড়ে ছিল। এই অংশে সংক্ষেপে বিষয়গুলি তুলে ধরা হচ্ছে।

ট্রুথ ট্রিলজি’র শেষ কিস্তি

বিবেক অগ্নিহোত্রীর ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ আসলে ‘ট্রুথ ট্রিলজি’-র শেষ অধ্যায়। এর আগে ‘দ্য তাসখেন্দ ফাইলস’ এবং ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ মুক্তি পেয়েছিল। এই সিরিজে তিনি বারবার সেইসব ইতিহাস সামনে আনেন, যা নিয়ে সাধারণত বলিউডের ছবিতে কথা হয় না। এখানে ইতিহাস, রাজনীতি, আর মানুষের রক্ত-মাংসের আবেগ—সব মিলিয়ে এক অন্য স্বাদ।

ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে (১৯৪৬): কলকাতার বিভীষিকা

ছবির কেন্দ্রে যে ঘটনাটি, সেটি হচ্ছে ১৬ আগস্ট, ১৯৪৬ সালের ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন তখন ব্যস্ত স্বাধীনতার প্রস্তুতিতে, আর ওই সময়ে মুসলিম লীগ নেতারা আলাদা রাষ্ট্রের দাবি নিয়ে ধর্মঘট ডাকে।
কলকাতার রাজপথে নামে বিশৃঙ্খলা—হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে হিংসা, পুড়িয়ে দেয়া বাড়ি, খুন-জখম, নিঃশেষ পরিবার। এসব বাস্তব ঘটনা ছবির ক্যামেরায় ধরা পড়েছে, অত্যন্ত বাস্তব রূপে। কারও কাছে এটা মনে হতে পারে নৃশংস, কারও কাছে ইতিহাসের অকৃত্রিম চিত্র।
আরো তথ্য পেতে দেখুন: Direct Action Day – উইকিপিডিয়া

নোয়াখালি ট্র্যাজেডি: পার্টিশনের ছায়া

ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-এর মাত্র কিছুদিন পরেই, পূর্ববঙ্গে (আজকের বাংলাদেশ) নোয়াখালিতে ঘটে আর এক মারাত্মক দাঙ্গা। প্রচুর হত্যা, অগ্নিসংযোগ, হিন্দুদের উপরে বর্বরতা—এই সবই ছবিতে ঠাঁই পেয়েছে। নোয়াখালির ঘটনার প্রেক্ষাপটে পরবর্তীতে গাঁধীজি সেখানে গিয়ে শান্তির চেষ্টা করেছিলেন, যা আজও বাঙালি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এই ঘটনাগুলো ছবির প্লটকে শক্তিশালী করেছে, মানুষের মনে অনেক পুরনো প্রশ্ন উস্কে দিয়েছে।
এ নিয়ে আরও পড়তে পারেন: The Bengal Files: নোয়াখালি গণহত্যা নিয়ে আর্টিকেল

মুসলিম-হিন্দু সম্পর্ক ও পার্টিশনের জটিলতা

ছবিতে দেখানো হয়েছে তৎকালীন দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্ক কেমন বিষিয়ে উঠেছিল, ইসলামী ও হিন্দু সাম্প্রদায়িক নেতৃত্বের রাজনৈতিক কৌশল কীভাবে সাধারণ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলেছিল। সেই পরিস্থিতি আর আজকের সময়ের পার্থক্যও তুলে ধরা হয়েছে, যাতে দর্শকরা শুধু ইতিহাস হিসেবে নয়, নিজেদের সমাজ-রাজনীতি সম্পর্কেও ভাবতে পারেন।

গোপাল চন্দ্র মুখার্জির ভূমিকা

ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে ও কলকাতার দাঙ্গায় গোপাল চন্দ্র মুখার্জি, যাঁকে সবাই গোপাল পাঠা নামে চেনেন, images/local-hero হিসেবে উঠে এসেছেন। কেউ কেউ তাকে যোদ্ধা বলে মনে করেন, যিনি নিজের এলাকায় হিন্দুদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন; আবার কেউ কেউ মনে করেন তার নেতৃত্বেই পাল্টা-হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। ইতিহাস বিভক্ত, এবং ছবির নির্মাতারাও এই কনট্রোভার্সিকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।
গোপাল মুখার্জিকে নিয়ে নানা বিতর্ক ও আইনি লড়াইও ছবি ঘিরে হয়েছে।
গোপাল পাঠা সংক্রান্ত আরও তথ্য জানতে পড়ুন: Gopal Patha মােন্দে বিতর্ক

ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও সমসাময়িক বিতর্ক

‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ সরাসরি এক জন্ম-ব্যথিত অধ্যায় তুলে ধরে, যেখানে ইতিহাসবিদদের মতে অনেক কিছুই আজও বিতর্কিত। দর্শকরা নতুন দিকে প্রশ্ন তুলছেন, ইতিহাসের আলো-আঁধারি রাজনীতির খেলা নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে শিখছেন।
ছবিটি নিয়ে আরও বিস্তারিত জানতে পারেন: The Bengal Files – উইকিপিডিয়া

এইভাবেই ছবির মূল বিষয়বস্তু আর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট একসাথে গেঁথে নতুন আলোচনার দরজা খুলে দিয়েছে।

কলকাতায় প্রথম স্ক্রিনিং: খোলা হাওয়া এবং ‘অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা’

‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ নিয়ে কলকাতার পরিবেশে বড়সড় চাঞ্চল্য দেখা গিয়েছে। দেশের নানা প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি মুক্তি পেলেও, বাংলায় হলের পর্দায় এই ছবি দেখা যায়নি। বিতর্ক, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞার আবহে ছবির প্রথম স্ক্রিনিং হয়েই উঠেছিল এক রকম প্রতিবাদের আলোচনা। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে খোলা হাওয়া সংগঠনের মাধ্যমেই অনুষ্ঠিত হয় এই বিশেষ স্ক্রিনিং, যেখানে সাধারণ দর্শক ছিলেন না, শুধুমাত্র আমন্ত্রিতরা সুযোগ পান। নিরাপত্তা কড়া, কেন্দ্রীয় পুলিশের উপস্থিতি স্পষ্ট বোঝায়—এটি শুধুই সিনেমার স্ক্রিনিং ছিল না, বরং এক রাজনৈতিক বার্তার অংশও বটে। বিস্তারিত জানতে, পড়ুন অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা ভেঙে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে ‘বেঙ্গল ফাইলস’

রাজনৈতিক বিতর্ক: তৃণমূল বনাম বিজেপি

কলকাতায় এই বিশেষ প্রদর্শনী নতুন করে রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দেয়। পশ্চিমবঙ্গের বড় দুই রাজনৈতিক শিবির—তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি—দুই পক্ষই সরব হয়ে ওঠে।

  • তৃণমূল শিবির বলছে ছবিটি পরিকল্পিত বিভাজন তৈরি করতে চায় এবং বাংলার সংস্কৃতির বিকৃতি ঘটাচ্ছে। তাঁদের দাবি, “ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে এই সিনেমার মাধ্যমে, তাই বাংলার মানুষের পক্ষে এটা ক্ষতিকর।”
  • বিজেপি-র বক্তব্য পুরোপুরি উল্টো। তাঁরা মনে করেন, “এটি ইতিহাসের অবিশ্বাস্য একটি অধ্যায় তুলে ধরেছে, যা সবাই জানার অধিকার রাখে। সিনেমার মুক্তিতে বাধা আসা মানে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় আঘাত!”

এই দুই পক্ষের টানাপোড়েন পরিস্থিতিকে আরো ঘোলা করেছে। এমনকি এই বিতর্কের মাঝখানে নায়ক-প্রযোজকরা সরকারি সহায়তার দাবি জানান, তাঁরা সরকারি পক্ষের সহযোগিতা চান যাতে বনগাঁ বা বিধাননগরের কোনও সিনেমা হলে ছবিটি প্রাসঙ্গিকভাবে মুক্তি পায়। অভিযোগ ওঠে—তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ হল মালিকরা ‘অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা’ চাপিয়ে ছবিটার জন্য হল খুলে দেয়নি।

এছাড়া আরও একটি বড় বিতর্ক-প্রচারণা উঠে আসে। কিছু অংশের অভিযোগ—ছবিটির প্রচার চলছে বিজেপি-ঘনিষ্ঠ মহলে, ফলে ছবিটি রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে, ছবির পক্ষে যুক্তি—এই বিতর্ক পুরোটাই রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার যন্ত্র এবং বিনোদনকে অযথা রাজনীতিকরণ।

এই ধরণের পরিস্থিতি বাংলা সিনেমার জগতে এক অনন্য নজির গড়ে তুলেছে, যেখানে একটি সিনেমা শুধু অভ্যন্তরীণ বিতর্ক নয়, বৃহত্তর রাজনৈতিক টানাপোড়েন, ভূমিকা ও ভাষ্যের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। আর সেই মুহূর্তে, একটি ক্লোজড স্ক্রিনিং যেন চুপিচুপি বলে দিয়ে গেল—বাংলার সাংস্কৃতিক পরিসরে এখনো সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নেই, সেই অঘোষিত অবরোধের দিকে তাকিয়ে আছে অসংখ্য চোখ।

আরও পড়তে পারেন:

বিবেক অগ্নিহোত্রীর দাবি: ‘দুই সংবিধান’ ও তার অর্থ

‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ নিয়ে বিবেক অগ্নিহোত্রীর সবচেয়ে আলোচিত বক্তব্য—”বাংলায় আজও দুটি সংবিধান চলছে”—এটাই নতুন আলোচনার সূচনা করেছে। সিনেমার প্রচারে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, ইতিহাসের ধারাবাহিক ঘটনাপ্রবাহ আজও এখানে রাষ্ট্র, সমাজ ও সংস্কৃতিতে গভীর ছাপ ফেলেছে। এই বক্তব্য শুনলে অনেকেই ভাবতে পারেন, আদৌ কি একই ভূখণ্ডে, একই আইনের ছায়ায়, এভাবে দ্বৈত নিয়মের বাস্তবতা চলে? আসুন, এই আলোচনার গভীরে যাই এবং বুঝে নিই বিভাজনের সামাজিক ও ঐতিহাসিক দিক।

Discover the stunning architecture of the Dakshineswar Kali Temple, a famous tourist attraction in Kolkata, India.
Photo by FUTURE KIIID

দুই সংবিধানের ধারণা: ইতিহাস ও সামাজিক বাস্তবতা

বিবেক অগ্নিহোত্রীর বক্তব্যের সূত্র কোথা থেকে এল? তার ভাষ্য অনুযায়ী, বহুদিন ধরেই বাংলায় এক ‘সরকারি সংবিধান’—যেটা সারা ভারতের জন্য, আরেকটা ‘অঘোষিত সংবিধান’—যেটা শক্তিশালী গোষ্ঠীগুলোর সামাজিক দাপট, রাজনৈতিক ভাগাভাগি বা ধর্মবিশ্বের ভিত্তিতে চলে। ১৯৪৬ সালের ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে থেকে শুরু করে নোয়াখালি দাঙ্গা—এসব বড় ঘটনা আসলে সমাজে ‘দুই নিয়ম’ বা ‘দুই আইন’-এর বীজ ছড়িয়ে দিয়ে গেছে।

আগে, ব্রিটিশ আমলে তো সরকারি আইন চালু ছিল ঠিকই, কিন্তু অনেকখানি ছিল ঐ অঞ্চলের সাম্প্রদায়িক নেতা বা জমিদারির নিয়ন্ত্রণ। স্বাধীনতার পরেও, সাড়ে সাত দশক কেটে গেল, কিন্তু নানা সময় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপের কারণে একশ্রেণির মানুষের জন্য অন্য রকম বিধান যেন চলে এসেছে—তা হয়তো বিচারব্যবস্থা, হয়তো জমি-সম্পত্তি, কখনও আইনশৃঙ্খলা বা ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে।
বিস্তারিত জানতে পড়ুন Vivek Agnihotri on Bengal Files premier in Kolkata

আজাদির আগে ও পরে: কীভাবে বিভক্তি গড়ে উঠল?

১৭-১৮ শতকের শেষ দিকে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন আজকের পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে আলাদা সামাজিক ও প্রশাসনিক নিয়ম গড়ে তোলে। মুসলিম ও হিন্দু জমিদারি, বিচারব্যবস্থা, ধর্মীয় নিয়ম ছিল বড় কর্তা। ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে ও নোয়াখালির মতো ঘটনার পরে, বাংলার হিন্দু-মুসলিম জনগণ আরও বেশি করে আলাদা সামাজিক-রাজনৈতিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত হন।

স্বাধীনতা-উত্তর কালে সংবিধান তো আসল, কিন্তু বাস্তবতার মাটিতে অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসন, স্থানীয় রাজনীতিক বা পুলিশি ব্যবস্থায় দলীয় বা গোষ্ঠীকেন্দ্রিক মাপকাঠি চলে এসেছে। একদিকে নাগরিক অধিকার, অন্যদিকে কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় নিয়ম বা ‘গোষ্ঠী-ধর্ম’– এই দ্বৈত ব্যবস্থা বহুদিন ধরে চলে আসছে বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞও।

ঐতিহাসিক ঘটনার প্রভাবে নাগরিক মনস্তত্ত্ব

নোয়াখালির গণহত্যা, স্থানীয় বসতি-দখল, জমি ভাগাভাগি, রাজনৈতিক রেষারেষি—এসব ঘটনা দীর্ঘ মেয়াদে নাগরিকদের মনস্তত্ত্বে গভীর ছাপ ফেলে। কে কার অভিভাবক, কে কোথায় বেশি আধিপত্য দেখাবে—এই প্রশ্নগুলোই, অগ্নিহোত্রীর মতে, ‘দুই সংবিধান’ তৈরি করেছে। ইতিহাসের স্কুলবইতে এসব লেখা না থাকলেও, বাংলার বাস্তব কথা বলে।

সরকারি পক্ষ ও বিরোধী দলের মন্তব্য

বিবেক অগ্নিহোত্রীর এই বক্তব্য নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া এসেছে দুই দিক থেকেই। সরকারি শিবির স্পষ্টভাবেই এই দাবিকে অস্বীকার করেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, “এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বাংলায় সংবিধানের বাইরে কিছু হয় না। ভারতীয় সংবিধানই সব পর্যায়ে কার্যকর।” তাদের দাবি, এই ধরনের বিভাজনমূলক বক্তব্য মানুষের মন বিষিয়ে দিতে পারে এবং তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

বিজেপি বা বিরোধী পক্ষ থেকে অন্যরকম সুর শোনা গিয়েছে। তাদের মতে, পশ্চিমবঙ্গে মাঝেমাঝে প্রশাসনিক পক্ষপাত, রাজনৈতিক বা সামাজিক বিভাজন খোলাখুলি ধরা পড়ে। যেমন, ভোটের সময় হিংসা, সংখ্যালঘু-মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন, পুলিশি কাজে দলীয় চাপ—এই সব উদাহরণ তুলে ধরে তারা বলেন, “এই কথার পেছনে কিছু সত্যি আছে। এইজন্যই সাধারণ নাগরিক বারবার ন্যায়বিচার ও সমানাধিকারের প্রশ্ন তোলে।”

এ নিয়ে আরও পড়ুন:

দুই সংবিধান বিতর্ক: দিনশেষে কী বোঝা যায়?

স্মৃতি, ইতিহাস, আইন, রাজনীতি—সব একসঙ্গে মিলে এই বিতর্ক তৈরি করেছে। কেউ বলছেন এটা অতিরঞ্জিত, কেউ বলছেন এটাই প্রকৃত বাস্তবতা। সিনেমার উদাহরণ টেনে অগ্নিহোত্রীর বক্তব্য আসলে যা তুলে ধরে, তা হলো—একই মাটিতে দাঁড়িয়ে মানুষ আলাদা আইন, নিয়ম বা আচরণ অনুভব করেন।
পরিস্থিতি বিভিন্ন সময় ভিন্ন হয়, কিন্তু আলোচনাটা বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক বর্তমান নিয়েই।

সিনেমার সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যত ইঙ্গিত

‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ কলকাতায় প্রথম স্ক্রিনিংয়ের পর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে আসছে। শুধু রাজনৈতিক নয়, এই সিনেমা সমাজে কতটা ঢেউ তুলছে—তা ফুটে উঠেছে দর্শকের সরাসরি প্রতিক্রিয়া, সামাজিক মিডিয়ার আলোচনা, ও নাগরিক জীবনের বিবর্তিত বোধে। সিনেমা নিয়ে তরুণ থেকে প্রৌঢ়—সবার মধ্যে স্পষ্ট দুটি ভাগ বিভাজন তৈরি হয়েছে। যারা ছবিটিকে ইতিহাসের সত্য উন্মোচন মনে করছেন; কেউ আবার একে নতুন বিভাজনের ইস্যু বলে মনে করছেন।

দর্শকের প্রতিক্রিয়া: আবেগ ও বিরোধ

স্ক্রিনিংয়ের দিনই দেখা গেছে—কেউ নির্বাক হয়ে গেছেন, অনেকের চোখে অশ্রু, কারো কন্ঠে ক্ষোভ। অনেকে বারবার বলেছেন, “এত বছর এই কথা কেউ বলেনি, ছোটবেলায় ইতিহাস বইয়ে এই অধ্যায় ছিল না!” আবার, কেউ কেউ ছবিটিকে অতিনাটকীয় বলে সমালোচনা করেছেন, বলেছেন “এতে নতুন করে ঘৃণা ছড়াতে পারে।” সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া পড়লেই বোঝা যায়, আবেগ ও বিতর্ক দুই-ই প্রবল। দর্শকদের কিছু লাইভ রিঅ্যাকশন পাওয়া যাচ্ছে এই ইনস্টাগ্রাম ভিডিওতে

সামাজিক মিডিয়ায় প্রতিফলন

সিনেমা মুক্তির পর, টুইটার, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে দর্শকেরা সরাসরি মনের কথা জানিয়েছেন। কেউ বলছেন, সিনেমাটা “সহজে চোখ খুলে দেয়”, আবার অনেকেই এটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা ধরনের হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করেছে—#TheBengalFiles #TruthTold, আবার এর বিপরীতে #PropagandaFilm, #DivideNotUnite-ও দেখা গেছে।

  • ছবির সমর্থকরা বলছেন, “অবশেষে সত্য প্রকাশ্যে এসেছে।”
  • সমালোচকদের মত, “এটা শুধু কষ্টের স্মৃতি জাগিয়ে, নতুন ঘটনার ইন্ধন জোগাবে।”

বিস্তারিত সামাজিক প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ পড়ুন The Bengal Files Twitter review: Vivek Agnihotri film divides এই প্রতিবেদনটিতে।

বাণিজ্যিক হলে স্ক্রিনিং : সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

কলকাতায় সিনেমা হলের বড় পর্দায় এখনো ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ মুক্তি পায়নি। একদিকে ‘অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা’, অন্যদিকে প্রেক্ষাগৃহ মালিকদের দ্বিধাবোধে পরিস্থিতি ঝুলে আছে।
দর্শক চাহিদা ও সামাজিক আলোচনার জন্ম সত্বেও, হলমালিকরা ঝুঁকি নিতে নারাজ—তাঁদের মনে নিরাপত্তা, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং রাজনৈতিক চাপের একটা স্থায়ী ছায়া।
তবে হালকা আলোর রেখা রয়েছে—অনেকেই মনে করছেন, যদি বলিষ্ঠ জনমত গড়ে ওঠে এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা আসে, তাহলে ভবিষ্যতে সিনেমাটি বাণিজ্যিক হলগুলোতেও চলতে পারে।
সম্প্রতি নিরাপত্তা ও বিতর্ক নিয়েই কঠোর নজরদারিতে কলকাতায় স্ক্রিনিং হয়েছে

সামাজিক বিভক্তি ও ঐতিহাসিক সত্য উন্মোচনের প্রভাব

এই সিনেমা পুরোপুরি স্পষ্ট করে দিয়েছে—একটি ইতিহাস নিয়ে সমাজে দ্বিমত থাকতেই পারে।
একদিকে ইতিহাসের আলোকপাত, অন্যদিকে রাজনৈতিক বা সামাজিক বিভক্তির আশঙ্কা দুই-ই উপস্থিত। এখানে কিছু স্পষ্ট বাস্তবতা গুরুত্ব পাচ্ছে:

  • ইতিহাস আরও ব্যাপক আলোচনার মধ্যে এসেছে: নতুন প্রজন্ম ইতিহাস জানতে আগ্রহী হচ্ছে।
  • সম্প্রদায়গত বিভক্তির আশঙ্কা: কেউ কেউ বলছেন অতীতের ক্ষত নতুনভাবে জাগতে পারে।
  • মৌলিক প্রশ্নবোধ জেগেছে: ‘কে শিকার, কে অপরাধী?’ এই প্রশ্নকে সামনে রেখেই অনেকেই নিজেদের পরিচয় ও ইতিহাস নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেছেন।

ছবির সবচেয়ে বড় প্রভাব—একটি অ্যাপার্টমেন্টের ড্রয়িং রুম কিংবা সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপে ‘বেঙ্গল ফাইলস’ নিয়ে আলোচনা চলছে, মানুষ নিজেদের পরিবার, বন্ধুদের সঙ্গে এ নিয়ে নতুন মত প্রকাশ করছে।

যা বলার, এই সিনেমা ইতিহাস চর্চা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি দুই ক্ষেত্রেই এক নতুন দিন শুরু করেছে—এখন দেখার, ভবিষ্যতে এই আলোড়ন কোন দিকে মোড় নেবে।

উপসংহার

‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ নিয়ে বিতর্ক শুধু সিনেমার পর্দায় আটকে নেই; বাংলার সামাজিক এবং রাজনৈতিক চেতনার মাঝেও তার জোয়ার-বদল দেখা যাচ্ছে। দুই সংবিধানের প্রশ্ন এই ছবির মাধ্যমে যেন আরও স্পষ্টভাবে সামনে এসেছে, যা অনেকের কাছে দীর্ঘদিনের অস্পষ্ট বাস্তবতা। কেউ এই গল্পকে ইতিহাসের গোপন অধ্যায় উন্মোচন বলে দেখছেন, আবার কেউ ভাবছেন সমাজে নতুন বিভাজনের বীজ বপন হচ্ছে।

এই বিতর্ক আমাদের শেখায়—ইতিহাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করা বা পুনরায় আলোচনায় আনা আসলে সমাজের সাহসিকতার পরিচায়ক। ছবিটির আলোচনার মধ্য দিয়েই বোঝা যায়, নাগরিক অধিকার, ন্যায্যতা ও স্মৃতির মূল্য এখনও বাংলার প্রতিটি তরুণ, চিন্তাশীল মানুষের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

আপনার মতামত, অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি আমাদের জানাতে ভুলবেন না। আলোচনা চলুক—কারণ ইতিহাসের সঙ্গে সামনে যাওয়া মানেই সত্য, সাহস আর সমবেদনার পথে এগিয়ে চলা।

Click here